উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন অনেকের মনে থাকে, কিন্তু এই পথে পা বাড়ানোর আগে বুঝতে হবে উদ্যোক্তা হওয়ার অর্থ কী এবং কেন আপনি এই পথ বেছে নিতে চান। এই সিরিজের প্রথম পর্বে আমরা উদ্যোক্তার সংজ্ঞা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর বাস্তবতা, চাকরি ও ব্যবসার তুলনা, ন নিজেকে প্রশ্ন করার গুরুত্ব, মানসিক প্রস্তুতি এবং কিছু স্থানীয় উদাহরণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এই আর্টিকেলটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে শূন্য জ্ঞানের একজন পাঠকও উদ্যোক্তা হওয়ার প্রাথমিক ধারণা পেয়ে যান এবং তাদের সম্ভাব্য সব প্রশ্নের উত্তর পান।

উদ্যোক্তার সংজ্ঞা ও বাস্তবতা (বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে)

উদ্যোক্তা হলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি নিজের উদ্যোগে একটি ব্যবসা শুরু করেন, নতুন ধারণা বা সমাধান নিয়ে কাজ করেন এবং ঝুঁকি নিয়ে নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য এগিয়ে যান। এটি শুধু একটি ব্যবসা শুরু করা নয়, বরং সমাজের সমস্যা সমাধান, নতুন সুযোগ তৈরি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উদ্যোক্তা হওয়া মানে সীমিত পুঁজি, অপ্রতুল অবকাঠামো এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারের মধ্যেও সৃজনশীলতা ও দৃঢ়তার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া।

বাংলাদেশে উদ্যোক্তারা প্রায়ই শুরু করেন ছোট পরিসরে। উদাহরণস্বরূপ, অনেকে ফেসবুক পেজ খুলে পোশাক, গহনা বা খাবার বিক্রি শুরু করেন। কেউ কেউ ফ্রিল্যান্সিং বা অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে পুঁজি জোগাড় করে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। তবে বাস্তবতা হলো, এই পথ সহজ নয়। আপনাকে মুখোমুখি হতে হবে:

তবুও, বাংলাদেশের তরুণরা প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ই-কমার্সের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সফল হচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, ShopUp বা Pathao-এর মতো স্টার্টআপ বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি বদলে দিচ্ছে।

সম্ভাব্য প্রশ্ন: উদ্যোক্তা হতে কি ব্যবসা সম্পর্কে পড়াশোনা জানতে হবে?
উত্তর: না, পড়াশোনা সহায়ক হলেও ব্যবসা শেখা যায় অভিজ্ঞতা, গবেষণা এবং পরামর্শের মাধ্যমে। অনেক সফল উদ্যোক্তার কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যবসায়িক শিক্ষা নেই।

Enturpanure vs Job
Photo by Andrea Piacquadio

চাকরি বনাম ব্যবসা – তুলনামূলক বিশ্লেষণ

চাকরি করবেন নাকি ব্যবসা শুরু করবেন, এটি একটি বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র, এবং বেতন প্রায়ই জীবনযাত্রার খরচের সঙ্গে মেলে না। অন্যদিকে, ব্যবসা আর্থিক স্বাধীনতা এবং সৃজনশীলতার সুযোগ দেয়, তবে ঝুঁকি বেশি। আসুন তুলনা দেখি:

বিষয়চাকরিব্যবসা
আয়নির্দিষ্ট এবং স্থিতিশীল, যেমন মাসে ২০,০০০-৫০,০০০ টাকা।শুরুতে কম বা অনিশ্চিত, তবে সফল হলে লাখ টাকা বা তার বেশি সম্ভব।
কাজের সময়নির্দিষ্ট (৯-৫), সাপ্তাহিক ছুটি থাকে।নমনীয়, তবে প্রায়ই দিনরাত কাজ করতে হয়, বিশেষ করে শুরুতে।
ঝুঁকিকম, তবে চাকরি হারানোর ভয়।বেশি, যেমন পুঁজি হারানো, বাজারে ব্যর্থতা।
স্বাধীনতাবসের নির্দেশ মানতে হয়, সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা কম।নিজের বস নিজে, সব সিদ্ধান্ত নিজের।
দীর্ঘমেয়াদী ফলপদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি সীমিত।সফল হলে সম্পদ, খ্যাতি এবং প্রভাব তৈরি করা সম্ভব।
দক্ষতা উন্নয়ননির্দিষ্ট কাজে দক্ষতা বাড়ে, তবে সীমিত।বাজার বিশ্লেষণ, মার্কেটিং, ফিনান্স সব শিখতে হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে:

সম্ভাব্য প্রশ্ন: আমি চাকরি করি, পাশাপাশি ব্যবসা করতে পারি?
উত্তর: হ্যাঁ, অনেকে শুরু করেন পার্ট-টাইম ব্যবসা দিয়ে। যেমন, অফিসের পর ফেসবুক পেজে পণ্য বিক্রি। তবে সময় ব্যবস্থাপনা ও শক্তি বণ্টন করতে হবে।

উদ্যোক্তা
Photo by David McEachan

উদ্যোক্তা হওয়ার আগে নিজেকে কিছু প্রশ্ন করা দরকার

উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজেকে কিছু প্রশ্ন করা জরুরি। এই প্রশ্নগুলো আপনার লক্ষ্য, প্রস্তুতি এবং বাস্তবতা পরিষ্কার করবে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং কেন সেগুলো জরুরি:

  1. আমি কেন উদ্যোক্তা হতে চাই?
  1. আমি কতটা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত?
  1. আমার দক্ষতা ও সংস্থান কী?
  1. আমার ব্যবসার লক্ষ্য কী?
  1. আমার ব্যাকআপ প্ল্যান কী?

কীভাবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন? একটি নোটবুকে প্রশ্নগুলো লিখে বিস্তারিত উত্তর দিন। আপনার উত্তর পরিবার বা অভিজ্ঞ বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন এবং তাদের মতামত নিন।

সম্ভাব্য প্রশ্ন: আমার লক্ষ্য পরিষ্কার না, তবু শুরু করতে পারি?
উত্তর: হ্যাঁ, কিন্তু শুরু করার আগে ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। যেমন, প্রথম মাসে ১০টি পণ্য বিক্রি করা। এটি আপনাকে দিকনির্দেশনা দেবে।

মানসিক প্রস্তুতি ও ঝুঁকির বাস্তবতা

উদ্যোক্তা হওয়া শুধু পণ্য বিক্রি বা টাকা আয় করা নয়, এটি একটি মানসিক যাত্রা। বাংলাদেশে উদ্যোক্তারা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। এখানে কিছু ঝুঁকি এবং কীভাবে মানসিকভাবে প্রস্তুত হবেন:

  1. আর্থিক ঝুঁকি:
  1. সামাজিক চাপ:
  1. বাজারের চ্যালেঞ্জ:
  1. মানসিক চাপ:

ঝুঁকি কমানোর টিপস:

সম্ভাব্য প্রশ্ন: আমার ব্যর্থতার ভয় আছে, কী করব?
উত্তর: ভয় স্বাভাবিক। ছোট থেকে শুরু করুন এবং প্রতিটি পদক্ষেপ থেকে শিখুন। একটি ডায়েরিতে আপনার অগ্রগতি লিখুন, এটি আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।

অনুপ্রেরণামূলক কিছু স্থানীয় উদাহরণ

বাংলাদেশে অনেক উদ্যোক্তা সীমিত সংস্থান নিয়েও অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। তাদের গল্প আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে:

  1. Fahim Saleh (Pathao):
    • গল্প: ঢাকার ট্রাফিক সমস্যা সমাধানের জন্য Pathao শুরু করেন। একটি রাইড-শেয়ারিং অ্যাপ থেকে শুরু করে এখন Pathao ডেলিভারি, ফুড ডেলিভারি এবং পেমেন্ট সার্ভিসে কাজ করে।
    • শিক্ষা: একটি স্থানীয় সমস্যা সমাধান করলে ব্যবসা বড় হতে পারে।
  2. Ehsan Ahmed (Khana’s):
    • গল্প: একজন গৃহিণী হিসেবে ঘরে তৈরি খাবার বিক্রি শুরু করেন। ফেসবুকের মাধ্যমে গ্রাহক তৈরি করে এখন তার ব্র্যান্ড ঢাকায় জনপ্রিয়।
      • শিক্ষা: স্বল্প পুঁজি ও সাধারণ দক্ষতা দিয়েও শুরু করা সম্ভব।
  3. Waseem Alim (Chaldal):
    • গল্প: অনলাইন গ্রোসারি প্ল্যাটফর্ম Chaldal শুরু করেন, যা এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামে হাজার হাজার গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দেয়।
    • শিক্ষা: প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ব্যবসাকে বড় করতে পারে।

কীভাবে এদের থেকে শিখবেন?

সম্ভাব্য প্রশ্ন: আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তবু কি সফল হতে পারি?
উত্তর: হ্যাঁ, উপরের উদাহরণগুলো দেখায় অভিজ্ঞতার চেয়ে ইচ্ছা ও শেখার মনোভাব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুরু করুন, শিখুন, এবং ধীরে ধীরে এগোন।

উদ্যোক্তা হওয়া একটি সাহসী এবং ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত। এটি আপনাকে আর্থিক স্বাধীনতা, সৃজনশীলতার সুযোগ এবং সমাজে প্রভাব ফেলার সুযোগ দেয়। তবে সাফল্য পেতে হলে পরিষ্কার লক্ষ্য, মানসিক প্রস্তুতি এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা জরুরি। নিজেকে প্রশ্ন করুন, ঝুঁকির জন্য প্রস্তুত হন এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের গল্প থেকে অনুপ্রেরণা নিন। এই সিরিজের পরবর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করবো কীভাবে সঠিক ব্যবসার আইডিয়া নির্বাচন করবেন এবং কোন পণ্য বিক্রি করা আপনার জন্য উপযুক্ত।


পর্ব ২: ব্যবসার আইডিয়া নির্বাচন – কী বিক্রি করবেন? কেন করবেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *