উদ্যোক্তা হওয়ার প্রথম ধাপ পেরিয়ে এসে এখন আপনার সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: কী বিক্রি করবেন এবং কেন এই পণ্য বা সেবা বেছে নেবেন? একটি সঠিক ব্যবসার আইডিয়া আপনার সাফল্যের ভিত্তি তৈরি করবে। এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো কীভাবে সমস্যা বা প্রয়োজনভিত্তিক আইডিয়া খুঁজবেন, চাহিদাযুক্ত পণ্য শনাক্ত করবেন, কোথা থেকে আইডিয়া নেবেন এবং স্বল্প বাজেটে সহজ ডেলিভারির জন্য উপযুক্ত পণ্য নির্বাচন করবেন। এই আর্টিকেলটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে শূন্য জ্ঞানের একজন পাঠকও ব্যবসার আইডিয়া নির্বাচনের প্রক্রিয়া বুঝতে পারেন এবং তাদের সম্ভাব্য সব প্রশ্নের উত্তর পান।

Photo by Ivan Samkov
সমস্যা ভিত্তিক বা প্রয়োজন ভিত্তিক আইডিয়া কীভাবে খুঁজবেন
একটি সফল ব্যবসার আইডিয়া সবসময় মানুষের কোনো সমস্যার সমাধান বা তাদের প্রয়োজন পূরণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা ও চাহিদা ভিন্ন, সমস্যা বা প্রয়োজন শনাক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কীভাবে সমস্যা খুঁজবেন?
- নিজের চারপাশে লক্ষ্য করুন:
- আপনার পরিবার, বন্ধু বা প্রতিবেশী কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন? উদাহরণস্বরূপ, গ্রামে সাশ্রয়ী দামে ভালো মানের শিশুদের পোশাক পাওয়া কঠিন। এটি একটি ব্যবসার সুযোগ হতে পারে।
- শহরে ব্যস্ত মানুষের জন্য ঘরে তৈরি খাবারের চাহিদা বাড়ছে। এটি থেকে হোমমেড ফুড ডেলিভারির আইডিয়া আসতে পারে।
- সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্রুপ পর্যবেক্ষণ:
- ফেসবুক গ্রুপ বা কমিউনিটি পেজে মানুষ কী নিয়ে অভিযোগ করছে দেখুন। যেমন, “ঢাকায় ভালো মানের জুতা কোথায় পাবো?” এই প্রশ্ন থেকে আপনি সাশ্রয়ী জুতার ব্যবসার আইডিয়া পেতে পারেন।
- নিজের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ:
- আপনি কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন? উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি অনলাইনে কেনাকাটা করতে গিয়ে দ্রুত ডেলিভারি না পান, তাহলে দ্রুত ডেলিভারির উপর ফোকাস করে একটি ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
- স্থানীয় বাজারে গবেষণা:
- স্থানীয় বাজারে গিয়ে দেখুন কোন পণ্যের চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ কম। যেমন, গ্রামে ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের দোকান কম থাকতে পারে।
প্রয়োজনভিত্তিক আইডিয়া:
- দৈনন্দিন প্রয়োজন: খাবার, পোশাক, গৃহস্থালি পণ্য।
- ট্রেন্ডি পণ্য: ফ্যাশনেবল জামা, মোবাইল এক্সেসরিজ, বা ফিটনেস গ্যাজেট।
- শিক্ষা ও সেবা: অনলাইন কোর্স, ফ্রিল্যান্সিং ট্রেনিং, বা গ্রাফিক ডিজাইন সার্ভিস।
সম্ভাব্য প্রশ্ন: আমার কোনো সমস্যা খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই, কী করব?
উত্তর: শুরুতে পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলুন। তাদের জিজ্ঞাসা করুন, “তোমার দৈনন্দিন জীবনে কোন জিনিসটির অভাব বোধ করো?” এছাড়া ফেসবুক গ্রুপে “কী ধরনের পণ্য চাও?” এমন পোস্ট দিয়ে প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করুন।
চাহিদা আছে এমন প্রোডাক্ট শনাক্ত করা
একটি পণ্য বা সেবা বিক্রি করার আগে নিশ্চিত করতে হবে যে এটির বাজারে চাহিদা আছে। বাংলাদেশে চাহিদাযুক্ত পণ্য শনাক্ত করার জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করুন:
- স্থানীয় চাহিদা বিশ্লেষণ:
- শহরে ফ্যাশন, গ্যাজেট, বা হোম ডেকোরের চাহিদা বেশি। গ্রামে সাশ্রয়ী পোশাক, কৃষি পণ্য, বা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস জনপ্রিয়।
- উদাহরণ: ঢাকায় মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য কাস্টমাইজড উপহার (মগ, ফটো ফ্রেম) বিক্রি ভালো চলে।
- ট্রেন্ড ফলো করা:
- ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা TikTok-এ কোন পণ্য বেশি প্রচার হচ্ছে দেখুন। যেমন, ২০২৫ সালে ওয়্যারলেস ইয়ারবাড বা ফিটনেস ট্র্যাকার জনপ্রিয়।
- Daraz-এর “টপ সেলিং” বিভাগ দেখুন। এখানে জনপ্রিয় পণ্যের তালিকা পাবেন।
- গ্রাহকের বাজেট বিবেচনা:
- বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ সাশ্রয়ী পণ্য পছন্দ করেন। ৫০০-২,০০০ টাকার মধ্যে পণ্য বিক্রি করা সহজ।
- উদাহরণ: ১,০০০ টাকার একটি টি-শার্টের চেয়ে ৩০০ টাকার টি-শার্ট বেশি বিক্রি হবে।
- মৌসুমি চাহিদা:
- ঈদ, পূজা, বা শীতকালে নির্দিষ্ট পণ্যের চাহিদা বাড়ে। যেমন, ঈদে পোশাক বা শীতে জ্যাকেট।
- উদাহরণ: শীতের আগে স্বল্প দামে হিটার বা ব্ল্যাঙ্কেট বিক্রি করা যেতে পারে।
কীভাবে চাহিদা যাচাই করবেন?
- ফেসবুক পেজে একটি পোল করুন। যেমন, “আপনি কোনটি কিনতে চান? অপশন ১: মোবাইল কভার, অপশন ২: ব্যাগ।”
- গুগল ট্রেন্ডস ব্যবহার করে দেখুন কোন পণ্যের সার্চ বাড়ছে। যেমন, “ব্যাকপ্যাক” বা “কানের দুল”।
- স্থানীয় দোকানে গিয়ে দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলুন। জিজ্ঞাসা করুন, “কোন পণ্য বেশি বিক্রি হয়?”
সম্ভাব্য প্রশ্ন: আমি যদি ভুল পণ্য বেছে নিই, তাহলে কী হবে?
উত্তর: ছোট পরিসরে শুরু করুন, যেমন ১০টি পণ্য কিনে বিক্রি করুন। বিক্রি না হলে অন্য পণ্য চেষ্টা করুন। প্রাথমিক ব্যর্থতা থেকে শিখে নতুন আইডিয়া নিন।

Photo by Jakub Zerdzicki
চীনের Aliexpress, 1688 বা দেশের হোলসেলার থেকে আইডিয়া নেওয়া
ব্যবসার আইডিয়া পেতে এবং পণ্য নির্বাচন করতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং স্থানীয় হোলসেলাররা দারুণ সাহায্য করতে পারে। এখানে কীভাবে এগুলো ব্যবহার করবেন:
- Aliexpress (www.aliexpress.com):
- এটি চীনের একটি জনপ্রিয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সাশ্রয়ী দামে পণ্য পাওয়া যায়।
- কীভাবে আইডিয়া নেবেন?
- “Best Sellers” বা “Trending Products” বিভাগে যান। এখানে জনপ্রিয় পণ্য দেখাবে, যেমন মোবাইল হোল্ডার, ওয়্যারলেস চার্জার।
- ফিল্টার ব্যবহার করে “Low Price” বা “Free Shipping” সিলেক্ট করুন।
- বাংলাদেশে কোন পণ্য বিক্রি হবে ভাবুন। যেমন, ১০০ টাকার মোবাইল স্ট্যান্ড বাংলাদেশে ৩০০ টাকায় বিক্রি করা যায়।
- সতর্কতা: শিপিং খরচ ও ডেলিভারি সময় (১৫-৪৫ দিন) চেক করুন।
- 1688 (www.1688.com):
- এটি Aliexpress-এর চেয়ে সস্তা, কিন্তু চীনা ভাষায়। গুগল ট্রান্সলেট ব্যবহার করুন।
- কীভাবে আইডিয়া নেবেন?
- পণ্যের ছবি দেখে বুঝুন কোনটি বাংলাদেশে চলবে। যেমন, ছোট LED লাইট বা রান্নাঘরের গ্যাজেট।
- বাংলাদেশে এজেন্ট (যেমন, চায়না থেকে পণ্য আমদানিকারক) দিয়ে পণ্য আনতে পারেন।
- সুবিধা: বাল্ক কেনায় দাম কম।
- দেশের হোলসেলার:
- ঢাকার চকবাজার, গাউছিয়া, বঙ্গবাজার বা চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে হোলসেল দোকানে যান।
- কীভাবে আইডিয়া নেবেন?
- দোকানদারদের জিজ্ঞাসা করুন, “কোন পণ্য বেশি বিক্রি হয়?” বা “নতুন কী এসেছে?”
- উদাহরণ: চকবাজারে সস্তায় মেয়েদের গহনা পাওয়া যায়, যা ফেসবুকে বিক্রি করা যায়।
- সুবিধা: শিপিং খরচ নেই, দ্রুত পণ্য পাওয়া যায়।
কীভাবে শুরু করবেন?
- Aliexpress থেকে ৫-১০টি পণ্যের তালিকা তৈরি করুন। দাম, শিপিং খরচ, এবং বাংলাদেশে বিক্রির সম্ভাবনা লিখুন।
- স্থানীয় বাজারে গিয়ে একই পণ্যের দাম তুলনা করুন। যেমন, Aliexpress-এ ২০০ টাকার একটি পণ্য বঙ্গবাজারে ১৫০ টাকায় পাওয়া যায় কি না।
- একটি নোটবুকে লিখুন: পণ্যের নাম, ক্রয়মূল্য, বিক্রয়মূল্য, মুনাফা।
সম্ভাব্য প্রশ্ন: আমি চীন থেকে পণ্য আনতে পারবো না, তাহলে কী করব?
উত্তর: স্থানীয় হোলসেলারদের থেকে শুরু করুন। ঢাকার বঙ্গবাজার বা আপনার এলাকার বাজারে গিয়ে ছোট পরিমাণে পণ্য কিনুন। পরে অভিজ্ঞতা হলে চীন থেকে আমদানি শিখুন।
স্বল্প বাজেট ও সহজ ডেলিভারির জন্য উপযুক্ত প্রোডাক্ট নির্বাচন
শূন্য থেকে শুরু করার জন্য এমন পণ্য বেছে নিন যা কম বিনিয়োগে বিক্রি করা যায় এবং ডেলিভারি সহজ। বাংলাদেশে স্বল্প বাজেটের উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু টিপস এবং পণ্যের উদাহরণ:
- কম ওজন ও ছোট আকারের পণ্য:
- কেন? এগুলোর শিপিং খরচ কম এবং স্টোরেজ সহজ।
- উদাহরণ:
- মোবাইল কভার (ক্রয়: ১০০ টাকা, বিক্রয়: ৩০০ টাকা)।
- কানের দুল বা চুলের এক্সেসরিজ (ক্রয়: ৫০ টাকা, বিক্রয়: ২০০ টাকা)।
- ছোট গৃহস্থালি পণ্য, যেমন কাটিং বোর্ড বা প্লাস্টিকের বক্স।
- টেকসই পণ্য:
- কেন? ডেলিভারির সময় ভাঙার ঝুঁকি কম।
- উদাহরণ: স্টিলের পানির বোতল, প্লাস্টিকের খেলনা, বা কাপড়ের ব্যাগ।
- স্বল্প বিনিয়োগে কেনা যায় এমন পণ্য:
- কেন? শুরুতে ৫,০০০-১০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করা সম্ভব।
- উদাহরণ: টি-শার্ট (ক্রয়: ১৫০ টাকা, বিক্রয়: ৪০০ টাকা), সানগ্লাস, বা মাস্ক।
- চাহিদা আছে এমন সেবা:
- কেন? সেবার জন্য পণ্য কিনতে হয় না, শুধু দক্ষতা লাগে।
- উদাহরণ: গ্রাফিক ডিজাইন, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, বা টিউশনি।
নির্বাচনের সময় যা বিবেচনা করবেন:
- মুনাফার হার: ক্রয়মূল্যের তুলনায় কমপক্ষে ৫০-১০০% মুনাফা রাখুন। যেমন, ১০০ টাকার পণ্য ২০০-৩০০ টাকায় বিক্রি।
- ডেলিভারি খরচ: কুরিয়ারে ৫০-১৫০ টাকার মধ্যে ডেলিভারি সম্ভব কি না।
- প্যাকেজিং: কাচের পণ্য এড়িয়ে চলুন, কারণ প্যাকেজিং খরচ বাড়ে।
- গ্রাহকের পছন্দ: মেয়েদের ফ্যাশন বা তরুণদের গ্যাজেট বেশি চলে।
উদাহরণ পরিকল্পনা:
- বাজেট: ১০,০০০ টাকা।
- পণ্য: মোবাইল কভার (১০০ টাকা/পিস, ৫০ পিস কেনা যাবে)।
- বিক্রয়: ৩০০ টাকা/পিস। মোট বিক্রি: ৫০ × ৩০০ = ১৫,০০০ টাকা।
- মুনাফা: ১৫,০০০ – ৫,০০০ (ক্রয়) – ২,৫০০ (ডেলিভারি) = ৭,৫০০ টাকা।
- পরবর্তী পদক্ষেপ: মুনাফা দিয়ে আরও পণ্য কিনুন বা মার্কেটিং বাড়ান।
সম্ভাব্য প্রশ্ন: আমার কাছে মাত্র ৫,০০০ টাকা আছে, কীভাবে শুরু করব?
উত্তর: স্থানীয় হোলসেল বাজার থেকে ৫০ টাকার ১০০টি পণ্য (যেমন, চুলের ক্লিপ) কিনুন। ১৫০ টাকায় বিক্রি করে মুনাফা করুন। ফেসবুকে বিনামূল্যে পোস্ট করে শুরু করুন।
ব্যবসার আইডিয়া নির্বাচন আপনার উদ্যোক্তা যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সমস্যা বা প্রয়োজন শনাক্ত করে, চাহিদাযুক্ত পণ্য বেছে নিয়ে এবং স্বল্প বাজেটে শুরু করে আপনি ঝুঁকি কমাতে পারেন। Aliexpress, 1688 বা স্থানীয় হোলসেলারদের কাজে লাগিয়ে সঠিক পণ্য খুঁজে নিন। পরবর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করবো কীভাবে বাজার বিশ্লেষণ করে টার্গেট কাস্টমার শনাক্ত করবেন, যাতে আপনার পণ্য সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছায়।
অতিরিক্ত টিপস শূন্য থেকে শুরু করার জন্য:
- একটি ফেসবুক পেজ খুলে আপনার পণ্যের ছবি পোস্ট করুন।
- ইউটিউবে “Product sourcing for beginners” সার্চ করে বিনামূল্যে শিখুন।
- স্থানীয় বাজারে গিয়ে দোকানদারদের সঙ্গে দরদাম শিখুন।
- প্রতিদিন ৩০ মিনিট Aliexpress বা Daraz ব্রাউজ করুন।